মরিচ


পুষ্টিমূল্য
 শুকনো মরিচে আমিষ, প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ‘সি’ থাকে। 

ভেষজ গুণঃ নিয়মিতভাবে কাঁচা মরিচ খেলে মুখে ‘ঘা’ হয় না। 
ব্যবহারঃ রান্না-বান্না ও মুখরোচক খাবার তৈরি ছাড়াও মরিচ বিভিন্ন ধরনের আচার তৈরির উপাদান হিসেবে ব্যবহার হয়। অনেকে মরিচের আচারও করে থাকেন।
উপযুক্ত জমি ও মাটিঃ প্রচুর আলো-বাতাস এবং  পানি, সেচ ও নিকাশের ব্যবস্থা আছে এমন দো-আঁশ মাটি মরিচ চাষের জন্য উপযোগী।

জাত পরিচিতিঃ ঝাল ও মিষ্টি এ ধরনের মরিচ দেখা যায়। ঝাল মরিচের মধ্যে বগুড়া, চাঁদপুরী, ফরিদপুরী উল্লেখযোগ্য। এছাড়া কামরাংগা, আকালী ও কালো মরিচ খুব ঝাল।

চারা তৈরিঃ জমি ভালভাবে চাষ ও ও মই দিয়ে ও আগাছা বাছাই করে ৩১ মিটার আকারের বীজতলা করে সেখানে বীজ বপন করা হয়। শীতকালের জন্য ভাদ্র-আশ্বিণ মাসে ও বর্ষা মৌসুমের জন্য ফাল্গুন-চৈত্র মাসে বীজতলায় বীজ বপন করা হয়। চারা ১০ সে.মি. উঁচু হলে রোপণের উপযোগী হয়।

চারা রোপণঃ আগাছা পরিষ্কার করে ৪-৫ টি চাষ ও মই দিয়ে জমি প্রস্তুতির পর চারা রোপণ করা হয়। চারা রোপণে সারি থেকে সারির দূরত্ব ৬০-৭০ সে.মি. ও চারা থেকে চারার দূরত্ব ৩০-৪০ সে.মি. রাখা হয়। চারা বিকেলে লাগাতে হবে এবং ২-৩ দিন সকাল বিকাল পানি দিতে হবে।

সার ব্যবস্থাপনাঃ মরিচের জমিতে প্রতি হেক্টরে গোবর ১০ টন, ইউরিয়া ২৫০ কেজি, টিএসপি ২০০ কেজি এবং এমওপি সার ১৫০ কেজি প্রয়োগ করা হয়। জমি তৈরির সময় সমুদয় গোবর, টিএসপি ও ৫০ কেজি  এমওপি সার প্রয়োগ করা হয়। চারা রোপণের ২৫ দিন পর ৮৪ কেজি ইউরিয়া ও ৩৪ কেজি এমওপি সার প্রথম উপরি প্রয়োগ করা হয়। লাগানোর ৫০ দিন পর ২য় ও ৭০ দিন পর তৃতীয় কিস্তির উপরি সার প্রয়োগ করা হয়। ২য় ও ৩য়   কিস্তির প্রতিবারে ৮৩ কেজি ইউরিয়া ও ৩৩ কেজি এমওপি সার প্রয়োগ করা হয়।
সেচ ও আগাছা ব্যবস্থাপনাঃ জমিতে রসের অভাব হলে সেচ দিতে হবে ও পানি নিকাশের ব্যবস্থা রাখতে হবে। আগাছা দেখা দিলে তা পরিষ্কার করতে হবে এবং উপরি সার প্রয়োগের সময় কোদাল দিয়ে কুপিয়ে আলগা করে দিতে হবে।

পোকা        
পোকার নাম : সাদা মাছি 
ভূমিকা : খুব ছোট আকারের এ পোকা পাতার রস চুষে খায়। ফলে গাছের বাড়বাড়তি ব্যহত হয়। তাছাড়া এ পোকা কালো সুটি মোল্ড নামক ছত্রাক পাতায় জন্মাতে  সহায়তা করে এবং ভাইরাস রোগ ছড়ায়। 

পোকা চেনার উপায় : সাদা রংয়ের এ পোকা গাছের পাতার নিচের দিকে থাকে। লম্বায় ১ মিলিমিটারের চেয়ে সামান্য বড়। গাছের পাতা সামান্য নাড়া দিলে উড়ে চলে যায়। এ সকল পোকার শরীর সাদা মোম জাতীয় পদার্থ দ্বারা ঢাকা থাকে। 

ক্ষতির নমুনা : 
- পাতার নিচের দিক হতে প্রাপ্ত বয়স্ক ও অপ্রাপ্ত বয়স্ক (নিম্ফ)  পোকা পাতার রস চুষে খায় ফলে পাতা কুঁচকে যায় এবং গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়।   
- আক্রমণে প্রথমে পাতায় সাদা বা হলদেটে রং দেখা যায় পরে দাগগুলো একত্রে হয়ে সবুজ শিরাসহ পাতা হলুদ হয়ে যায়।  
- এ পোকা খাওয়ার সময় আঠালো মিষ্টি রস  নি:সরণ করে বিধায় ঐ আঠাতে কালো ছত্রাক জন্মাতে সহায়তা করে।  
- এ পোকা ভাইরাস রোগ ছড়ায়। 

অনুকুল পরিবেশ :  উষ্ণ ও শুষ্ক আবহাওয়া এ পোকা বিস্তারের জন্য সহায়ক। 

জীবন চক্র : এ পোকা সাধারনত পাতার নিচের দিকে অতি ক্ষুদ্র সাদা ডিম পাড়ে। ডিম পরে বাদামী রং ধারণ করে ও ৩-১৭ দিন পর ডিম ফুটে নিম্ফ (বাচ্চা ) বের হয়। বাচ্চা সবুজাভ সাদা, ২-৬ সপ্তাহ নিম্ফ অবস্থায় থেকে  পূর্ণাঙ্গ পোকায় পরিণত হয়। পূর্নাঙ্গ পোকা ১০-১৫ দিন বাঁচে। 

ব্যবস্থাপনা : হলুদ রংয়ের আঠালো ফাঁদ ব্যবহার করতে হবে। প্রতি লিটারের ৫ গ্রাম কাপড় কাঁচা সাবান মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। 
- অনুমোদিত কীটনাশক নির্ধারিত মাত্রায় ব্যবহার করতে হবে। 

থ্রিপস 
পোকার নাম : থ্রিপস 
ভূমিকা : এটি একটি ক্ষুদ্র পোকা। আক্রমণ বাহির হতে বোঝা যায় না বিধায় ক্ষতির সমূহ সম্ভাবনা থাকে। সুতরাং মাঝে মাঝে ক্ষেত পরিদর্শন করে ফসলের অবস্থা দেখে আগে থেকেই ব্যবস্থা নিতে হবে। 

পোকা চেনার উপায় : থ্রিপস অতি ক্ষুদ্র একটি পোকা যা খালি চোখে কোন মতে দেখা যায়। এ পোকা পাতার রস চুষে খায়। ফলে অধিক আক্রমণে পাতা কুঁচতে যায় এমনকি গাছ থেকে কোন ফুল ফল নাও আসতে পারে। এ পোকা ভাইরাস রোগও ছড়ায়। 

ক্ষতির নমুনা 
- নিম্ফ (বাচ্চা )ও পূনাঙ্গ পাতার রস চুষে খায় বলে পাতা কুঁকড়িয়ে যায় এবং অনেকটা  নৌকার মত দেখায়।  
- পোকার আক্রমনে পাতা বাদামী রং ধারন করে। 
- নতুন ও পুরাতন উভয় পাতায় আক্রমন করে। 

অনুকুল পরিবেশ : উষ্ণ ও শুষ্ক আবহাওয়া ।
জীবন চক্র : পূর্ণ বয়স্ক পোকা ৪৫-৫০টি ডিম পাড়ে। ৫-৬ দিনে ডিম থেকে নিম্ফ (বাচ্চা) বের হয় এবং নিম্ফ ৭-৮ দিন পর পূর্নাঙ্গ পোকায় পরিণত হয়। র্পূনাঙ্গ পোকা ৩১ দিন পর্যন্ত বাঁচে। পাতা নাড়াচাড়া করলে এরা উড়ে পালায় । 

ব্যবস্থাপনা : সাদা রংয়ের আঠালো ফাঁদ ব্যবহার 
- মাকড়সা এ পোকা খায় বিধায় এর সংখ্যা বাড়ানো গেলে সহজেই থ্রিপস দমন করা যায়। 
- অনুমোদিত কীটনাশক সঠিক মাত্রায় প্রয়োগ । 

জাব পোকা
পোকার নাম : জাব পোকা 
ভূমিকা : র্পূনাঙ্গ ও নিম্ফ  (বাচ্চা) পাতা, ফুল, কচি ফল ও ডগার রস চুষে খায়। অধিক আক্রমনে গাছের বাড় বাড়তি কমে যায় ও ফলন কম হয়। এ পোকা ভাইরাস রোগ ছড়ায়। 

পোকা চেনার উপায় : জাব পোকা অতি ছোট, দেহ নরম ও উজ্জ্বল কাল রংয়ের হয়ে থাকে। পাখাওয়ালা জাব পোকা উড়তে পারে কিন্তু নিম্ফ বা পাখা বিহীন উড়তে পারে না । এরা দল বদ্ধ ভাবে বাস করে। 

ক্ষতির নমুনা : পূর্নাঙ্গ ও নিম্ফ পাতা, ফুল কচি ফল ও ডগার রস চুষে খায়। 
- পাতা কুঁকড়ে যায়, গাছের বৃদ্ধি ও ফুল, ফল ধারণ বাধাগ্রস্থ হয়  
- এ পোকা থেকে নি:সৃত মধুরসে কালো শুটি মোল্ড ছত্রাক জন্মায়। 
অকুকুল পরিবেশ : বাতাসে আদ্রতা বেশী ও মেঘলা আকাল 

জীবন চক্র : এ পোকা কোন যৌন মিলন ছাড়াই ১০-১২ দিনের মধ্যে  ৮-৩০ টি নিম্ফ জন্ম দিতে পারে। নিম্ফ অবস্থা ৫-৮ দিন থাকে।  পাখা বিহীন জাব পোকা ২৪ ঘন্টার মধ্যে বাচ্চা দিতে পারে। এরা সারা বছর বংশ বিস্তার করে। 

ব্যবস্থাপনা : আক্রমনের প্রাথমিক অবস্থায় হাত দিয়ে পিষে মেরে ফেলা । 
- লেডি বার্ড বিটলের পূর্নাঙ্গ ও কীড়া (গ্লাব) এবং সিরফিড ফ্লাই এর কীড়া জাব পোকা খায় বিধায় এদের সংরক্ষণ ও সংখ্যা বাড়ানো গেলে জাবপোকা অতিদ্রুত খেয়ে ফেলে ।
-  অনুমোদিত কীট নাশক ব্যবহার করা 

পোকার নাম : ফলছিদ্রকারী পোকা 
ভূমিকা : এ পোকার মথ নিশাচর এবং রাতের আলোতে আকৃষ্ট হয়। পোকার কীড়ার আক্রমণে মরিচ ছিদ্র যুক্ত দেখায় ও বাজার মূল্য কমে যায। 
পোকা চেনার উপায় : মা পোকাকে (মথ) সাধারনত রাত ছাড়া দেখা যায় না । কীড়াকে (বাচ্চা) ফলের মধ্যে দেখা যায়। কীড়া লম্বায় প্রায় ২ ইঞ্চি। কীড়ার গায়ের রং কালচে ধূসর থেকে হালকা বাদামী এবং শরীরের উভয় পার্শ্বে লম্বালম্বি হালকা কাল ও বাদামী রংয়ের দাগ দেখা যায়। 

ক্ষতির নমুনা : কীড়া ফলের বোটার কাছে ছিদ্র করে ভেতরের অংশ খায়। 
- একটি পোকা একাধিক ফলে আক্রমন করতে পারে এবং ফলের ভেতর কীড়ার বিষ্ঠা ও পচন দেখা যায়। 
- আক্রান্ত ফল অসময়ে পাকে। 

অনুকুল পরিবেশ : বিকল্প পোষকের উপস্থিতি । 

জীবন চক্র : মথ পাতার নিচে ২০০-৩০০ ডিম পাড়ে। ৩-৪ দিনে ডিম ফোটে কীড়া বের হয়। ছোট কীড়া একত্রে থাকে তবে বড় হলে সারা মাঠ ছড়িয়ে পড়ে। কীড়া ১৪-১৬ দিন পর পুত্তলিতে পরিণত হয়। পুত্তলি ২-৩ ইঞ্চি মাটির গভীরে থাকে।  ১০-১৫ দিন পর পুত্তলি হতে পূর্ণাঙ্গ মথ বের হয়।  জীবনচক্র সম্পন্ন করতে ৩০-৩৫ দিন লাগে । এরা বছরে ৮বার বংশ বি¯তার করে। 

ব্যবস্থাপনা  : জমি থেকে ডিম ও কীড়া সংগ্রহ করে নষ্ট করা।   
- প্রতি বিঘায় ১৫ টি হারে সেক্স ফেরোমন ফাঁদ ব্যবহার করে পুরুষ মথ মেরে ফেলা। 
-প্রতি সপ্তাহে একবার করে পরজীবী পোকা; ট্রাইকোগ্রামা কাইলোনিজ ব্যবহার (প্রতি হেক্টরে ১ গ্রাম ডিম) করা। 
- অনুমোদিত কীটনাশক ব্যবহার করা। 

মরিচের চওড়া মাকড়
নাম : চওড়া মাকড় 
ভূমিকা : এদের পা ৮ টি বলে মাকড় বলে । বালিকণার মত ক্ষুদ্র বলে দেখা যায় না কিন্তুু  এদের আক্রমণে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়ে থাকে। 
মাকড় চেনার উপায় : মাকড় অতি ক্ষুদ্র, খালি চোখে দেখা যায় না, রং সাদা বা হলদে । এরা পাতার নিচে মধ্য শিরা ঘিরে দলবদ্ধভাবে বসবাস করে। দেহ নরম, ডিম্বাকৃতির।  এরা কাঁকড়ার মত দেখায়। 

ক্ষতির নমুনা : পাতার নীচে থেকে রস চুষে খায় ফলে পাতার শিরার মধ্যকায় এলাকার বাদামী রং ধারণ করে ও শুকিয়ে যায়। 
- আক্রান্ত পাতা কুঁকড়িয়ে  যায় এবং কচি পাতার নীচের দিকে বেঁকে পেয়ালা আকৃতির হয়ে যায় ও পাতা সরু হয়। 
- ব্যাপক আক্রমণে পাতা ভেঙ্গে যায়। 
- ফলন ব্যাপকভাবে কমে যায়।   

অনুকুল পরিবেশ : বিকল্প পোষক। 

জীবন চক্র : স্ত্রী মাকড় পাতার নীচে ৩০-৭৬ টি ডিম পাড়ে।  ২-৩ দিনের মধ্যে ডিম থেকে কীড়া বের হয়।  ২-৩ দিন পর কীড়াগুলো নিম্ফে পরিণত হয় এবং ১ দিন পর পূর্ণাঙ্গ মাকড়ে পরিণত হয়।  পূর্ণাঙ্গ স্ত্রী মাকড় ৮-১৩ দিন বাঁচে ও পুরুষ মাকড়  ৫-৯ দিন বাঁচে। 
ব্যবস্থাপনা : আক্রমণের শুরুতে হাত দিয়ে আক্রান্ত পাতা সংগ্রহ করে ধ্বংশ করতে হবে। 
-    প্রতি লিটার পানিতে নিম তেল ৫ মিলি + ৫ মিলি ট্রিকস্ মিশিয়ে পাতার নিচের দিকে ¯েপ্র করতে হবে। 
-    পাইরিথ্রয়েড জাতীয় কীটনাশক প্রয়োগ যথা সম্ভব এড়িয়ে চলতে হবে।