গম ক্ষেতে সমন্বিত পদ্ধতিতে ইঁদুর দমন

গম ক্ষেতে সমন্বিত পদ্ধতিতে ইঁদুর দমন

গম ক্ষেতে সমন্বিত পদ্ধতিতে ইঁদুর দমন

গম দানাদার খাদ্যশস্য হিসেবে বাংলাদেশে দ্বিতীয় স্থান দখল করে আছে। উন্নত চাষাবাদ পদ্ধতি, উচ্চ ফলনশীল বীজ, সেচ ও সার ব্যবহারের মাধ্যমে এদেশে দিন দিন গমের আবাদ ও ফলন উভয়ই বাড়ছে। গত ২০১৩-১৪ গম আবাদ মৌসুমে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসেব অনুযায়ী ৩.৫৮ লাখ হেক্টর জমিতে ৯.৯৫ লাখ মেট্রিক টন গম উৎপাদিত হয়েছে যা হেক্টরপ্রতি গড় ফলন প্রায় ৩.০০ মেট্রিক টন।

ইঁদুর স্তন্যপায়ী, সর্বভুক ও নিশাচর  প্রাণী। ফসলের জন্য ক্ষতিকর স্তন্যপায়ী প্রাণিদের মধ্যে ইঁদুর মানুষের প্রধান শত্রু। কৃষি প্রধান বাংলাদেশে ইঁদুর আমাদের প্রধান সমস্যা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (১৯৬৭) হিসাব মতে, ইঁদুর প্রতি বছর বিশ্বের ৩ কোটি ৩৩ লাখ টন খাবার নষ্ট করে। বিশ্বে প্রতি বছর ইঁদুর যে পরিমাণ খাবার নষ্ট করে, সে খাবার খেয়ে অনায়াসেই ২৫/৩০টি দরিদ্র দেশের মানুষ এক বছর বাঁচতে পারে। প্রতিবছর দেশে ইঁদুরের কারণে গড়ে ৫০০ কোটি টাকারও বেশি ফসলের ক্ষতি করে থাকে। ২০১৪-১৫ অর্থ বছরে ইঁদুর প্রায় ৭২৪ কোটি টাকার ফসলের ক্ষতি করেছে (দৈনিক প্রথম আলো ২২ জুন ২০১৫)। কৃষি সংস্থা ইউ  এসডি এর ২০১০ সালের বিশ্বব্যাপী ইঁদুরের ক্ষতি করা নিয়ে গবেষণায় বলা হয়েছে ইঁদুর এশিয়ায় বছরে ১৮ কোটি মানুষের ১২ মাসের খাবার নষ্ট করে। বাংলাদেশে প্রায় ৮-১০ শতাংশ ধান ও গম ইঁদুর নষ্ট করে যা ৫০-৫৪ লাখ লোকের এক বছরের খাবারের সমান। ইঁদুর বছরে আমন ধানের শতকরা ৫-৭ ভাগ, গমের শতকরা ৪-১২ ভাগ, গোলআলুর শতকরা ৫-৭ ভাগ, আনারসের শতকরা ৬-৯ ভাগ নষ্ট করে । ইঁদুর শুধুমাত্র গম ফসলে বছরে প্রায় ৭৭,০০০ মেট্রিক টন ক্ষতি করে যার আনুমানিক মূল্য প্রায় ১৫০ কোটি টাকা।  ইঁদুর দ্বারা বছরে ফসলের প্রায় ১.৫-২.০ হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হয়। তাছাড়াও ইঁদুর প্রায় ৪০ প্রকার রোগ ছড়ায়। বেশির ভাগ ইঁদুর গর্তে বাস করে বলে সম্পূর্ণভাবে দমন বা নির্মূল করা সম্ভব হয় না।

বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রায় ১৮ প্রজাতির ইঁদুর দেখা যায়। তবে এদের মধ্যে মাঠের কালো ইঁদুর  (Lesser bandicoot rat, Bandicota benglensis (Gray) মাঠ ফসলে সব চেয়ে বেশিক্ষতি করে থাকে। এরা মাঝারি আকৃতির ওজন প্রায় ১৫০-২৫০ গ্রাম, পশম কালো ধূসর রঙের। ইঁদুর মাঠ ও গুদামে উভয় স্থানেই গর্ত করে ফসল কেটে, খেয়ে, গর্তে নিয়ে, গুদামে খেয়ে, পায়খানা, প্রস্রাব ও পশম মাটি ও শস্যের সাথে মিশিয়ে ব্যাপক ক্ষতি করে থাকে। গম উৎপাদনে পোকামাকড়, রোগবালাই এর উপদ্রব থাকলেও প্রধান অন্তরায় হচ্ছে ইঁদুর। গ্রামাঞ্চলে ‘কথায় বলে ইঁদুর গমের যম’। বীজ গজানো থেকে শুরু করে গম কাটা পর্যন্ত মাঠে ইঁদুরের উপদ্রব দেখা যায়। গম ফসলে এরা কুশি বের হওয়া অবস্থা থেকে পরিপক্ব অবস্থা পর্যন্ত বেশি ক্ষতি করে থাকে। তবে ইঁদুর শিষ বের হওয়া অবস্থায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে থাকে। শিষ বের হওয়ার  শুরু থেকে কুশি কেটে গাছের নরম অংশের রস খায় ও পরে গাছ কেটে ও গম খেয়ে ফসলের ক্ষতি করে। গম যতই পরিপক্ব হতে থাকে ক্ষতির পরিমান ততই বাড়তে থাকে। ইঁদুর গাছ কেটে গমসহ শীষ গর্তে নিয়েও প্রচুর ক্ষতি করে থাকে। একটি ইঁদুর এক রাতে ১০০-২০০ টি পর্যন্ত কুশি কাটতে সক্ষম।       

           
সমন্বিত পদ্ধতিতে ইঁদুর দমন
ইঁদুর  দমনের জন্য বেশ কয়েকটি পদ্ধতি  আছে। যেমন - অরাসায়নিক, রাসায়নিক, জৈবিক নিয়ন্ত্রণ, গ্যাস বড়ি, আঠা, পরভোজী প্রাণী  ইত্যাদি। এ সব পদ্ধতি  প্রয়োগ করে ইঁদুর দমনকে  সমন্বিত  দমন  পদ্ধতি বলে।


অরাসায়নিক দমন পদ্ধতি
মাঠে ইঁদুরের উপস্থিতি লক্ষ রাখতে হবে এবং দেখা মাত্রই  মারার ব্যবস্থা করতে হবে। জমির আইল ও আশেপাশের ঝোপ জঙ্গল পরিষ্কার রাখতে হবে। জমির আইল ছেঁটে চিকন রাখতে হবে যাতে ইঁদুর গর্ত করে বংশ বিস্তার ও ফসলের ক্ষতি করতে না পারে। সতেজ গর্তে শুকনা মরিচের ধোঁয়া দিয়ে ও পানি ঢেলে ইঁদুর দমন করা যায়। গর্তে গোবরের মিশ্রণ (২০-৩০%) দিয়েও গর্তের  ইঁদুর দমন করা যায়। ইঁদুর দমন কর্মসূচির মাধ্যমে কৃষক বা জনগণকে সচেতন করে তুলতে হবে ও একযোগে ইঁদুর মারার ব্যবস্থা নিতে হবে।

বিভিন্ন রকমের জীবন্ত ও মরণফাঁদ মাঠে ব্যবহার করে ইঁদুর দমন করা যায়। জীবন্ত ফাঁদের ভিতর বাঁশের ফাঁদ, লোহার তারের তৈরি ফাঁদ, কাঠের তৈরি ফাঁদ ইত্যাদি। মরণ ফাঁদের মধ্যে বাঁশের ও লোহার তৈরি ফাঁদ এলাকা ভিত্তিক পাওয়া যায়। তবে আকর্ষণীয় ও সুস্বাদু খাবার যেমন শুঁটকিমাছ ও নারিকেল দিলে ইঁদুর ফাঁদে পড়ার সম্ভাবনা বেশি। গবেষণায় দেখা গেছে যে, খাবারের সাথে কার্বনডাই ফসফাইড (০.১-৫ পিপিএম) টোপ হিসেবে দিলে ফাঁদে আটকানোর সক্ষমতা বৃদ্ধি পায় (প্রায় ৭০% সফলতা) ।


বপন পদ্ধতি পরিবর্তনের মাধ্যমে
বপন পদ্ধতির ওপর ইঁদুরের আক্রমণ কমবেশি হয়ে থকে। যেমন গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায় যে, সারিতে বপন ছিটিয়ে বপনের চেয়ে ইঁদুরের আক্রমণ কিছুটা কম হয় আবার বেড পদ্ধতিতে গম আবাদ করলে ইঁদুরের আক্রমণ কম হয়।


পরভোজী প্রাণী দ্বারা
শিয়াল, বনবিড়াল, বিড়াল, পেঁচা, সাপ, গুইসাপ, বেজী, বাজপাখি ইত্যাদি প্রাণী  ইঁদুর  খায়। এসব পরভোজী প্রাণির সংখ্যা বৃদ্ধির পরিবেশ সৃষ্টির  মাধ্যমে প্রাকৃতিক উপায়ে ইঁদুর  দমন করা সম্ভব।


রাসায়নিক দমন বা ইঁদুরনাশক দিয়ে দমন
বাজারে দুই ধরনের ইঁদুরনাশক পাওয়া যায়। প্রথমটি হল তীব্র বা তাৎক্ষণিক বিষ, এটি খাওয়ার সাথে সাথে বা ২/১ ঘণ্টার মধ্যে ইঁদুর মারা যায়, যেমন জিংকফসফাইড (২%) বিষটোপ।

অনিষ্টকারী মেরুদণ্ডী প্রাণী বিভাগ থেকে ফরমুলেশনকৃত জিংক ফসফাইড (২%) বিষটোপ  সাফল্যজনকভাবে গর্তের ইঁদুর দমন করা যায়। বিষটোপ তৈরির পদ্ধতি হলো একটি এ্যালুমিনিয়ামের পাত্রে ১০০ মিলিলিটার পানির মধ্যে ১০ গ্রাম সাগু বা বার্লি মিশিয়ে জ্বাল দেয়ার পর যখন পানি ঘন আঠাল হয়ে আসবে তখন পাত্রটি নামিয়ে ঠাণ্ডা করে ২৫ গ্রাম জিংক ফসফাইড ২% তার সাথে  ভালোভাবে মিশিয়ে ৯৬৫ গ্রাম গম ঢেলে দিতে হবে। পাত্রের ভিতরে গম নেড়ে চেড়ে এমন ভাবে মিশাতে হবে যেন সমস্ত গমের গায়ে কাল আবরণ পড়ে এবং পাত্রের মধ্যে জিংক ফসফাইড মিশানো সাগু বা বার্লি অবশিষ্ট না থাকে। এরপর মিশ্রিত গম ৩ থেকে ৪ ঘণ্টা রোদে শুকিয়ে ঠাণ্ডা করে বায়ুরোধক পাত্রে রেখে দিতে হবে। পরে সেখান থেকে নিয়ে প্রয়োজন মতো ব্যবহার করতে হবে। এ বিষটোপ পর পর দুই থেকে তিন দিনের বেশি ব্যবহার না করাই ভালো কারণ পরবর্তীতে বিষটোপ লাজুকতা দেখা দিতে পারে।


দ্বিতীয় ইঁদুরনাশক হলো বহুমাত্রা বা দীর্ঘমেয়াদি বিষ। যেমন- লানির‌্যাট, স্টর্ম, ব্রোমাপয়েন্ট, ক্লেরাট। এসব ইঁদুরনাশক খাওয়ার ৬/৭ দিনের মধ্যেই ইঁদুর মারা যায়। জীবিত ইঁদুরেরা বুঝতেই পারেনা যে এ বিষটোপই তাদের সঙ্গীদের মৃত্যুর কারণ। সেজন্য এরা বিষটোপ খেতে ভয় পায়না। ফলে ইঁদুর দমনে সফলতার হার অনেক বেশি। যে সব ক্ষেতে গর্তের মুখে নতুন মাটি তোলা দেখা যায়, সে সব গর্তের ভিতর বা আশপাশে কোনো পাত্রে বিষটোপ প্রয়োগ করতে হবে।

ব্যবহার বিধি
মাঠে যেখানে ইঁদুরের উপস্থিতি বুঝা যায় সেখানে বা ইঁদুর চলাচলের রাস্তায় বা সতেজ গর্তের আশপাশে জিংক ফসফাইড বিষটোপ কোনো পাত্রে রেখে দিতে হবে। জমির ওপর এইভাবে বিষটোপ দিয়ে ইঁদুর দমন করা একটি বড় সমস্যা হল প্রায়ই ইঁদুর এই বিষটোপ খেতে চায় না এবং বৃষ্টি বাদলের দিনে ভিজে নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা বেশি যার ফলে ইঁদুর দমনে কাক্সিক্ষত সফলতা আসে না। বিশেষ করে গম বা ধান ক্ষেতে যখন ইঁদুরের আক্রমণ হয় তখন পাকা গম বা ধান না খেয়ে বিষটোপ খাবার সম্ভাবনা  খুব কম। তাই জমির উপরে বিষটোপ না দিয়ে ৩-৪ গ্রাম বা ৮-১০ টি বিষমাখা (জিংক ফসফাইড) গম ৮ ও ৬  (সেমি.) আকারের একটি কাগজ দিয়ে পুঁটলি বেঁধে সতেজ গর্তের মুখ পরিষ্কার করে গর্তের ভিতর ঢুকিয়ে দিতে হবে। গর্তের ভিতর কাগজের পুঁটলিটি এমনভাবে নিক্ষেপ করতে হবে যেন গর্তের মুখ থেকে আনুমানিক ৮-১০ ইঞ্চি ভিতরে যায়। প্রয়োজনে একটি ছোট কাঠি দিয়ে গর্তের ভেতরে ঠেলে দেয়া যেতে পারে। তবে সব সময় লক্ষ রাখতে হবে কাগজটি যেন কখনো মাটির নিচে চাপা না পড়ে। এরপর গর্তের মুখ হালকাভাবে মাটি দিয়ে বন্ধ করে দিতে হবে। এভাবে বিষটোপ প্রয়োগের সুবিধা হলো (১) এই বিষটোপ  ইঁদুর বেশি খায় (২) অন্য কোন প্রাণী যেমন পাখি, বিড়াল, কুকুর বা অন্যান্য পোষা প্রাণী এই বিষটোপ খেতে পারেনা। এতে অপ্রত্যাশিত প্রাণির মৃত্যুর সম্ভাবনা থাকেনা। তাছাড়া পরিবেশ দূষণের সম্ভাবনাও খুব কম। মৃত ইঁদুর গর্তের ভিতর থাকে বলে মৃত ইঁদুর খেয়ে কাক, চিল ও বিড়াল মারা যাওয়ার সম্ভাবনা থাকেনা। এই পদ্ধতির সফলতা প্রায় ২৫% বেশি। তাছাড়া কৃষক ভাইদের তেমন কোনো বাড়তি খরচ নেই। তাই গর্তের ভিতরের ইঁদুর সফলভাবে দমনের জন্য এই পদ্ধতি বেশ লাভজনক হওয়ায় কৃষকরা সহজেই এই পদ্ধতি ব্যবহার করতে পারেন।

 

গ্যাসবড়ি দিয়ে ইঁদুর দমন
বিষটোপ ছাড়া এক প্রকার গ্যাস বড়ি দিয়েও ইঁদুর দমন করা যায়। যেমন-এ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট। এই ট্যাবলেট বাজারে ফসটক্সিন, কুইকফিউম, কুইকফস, সেলফস, ডিসিয়া গ্যাস এক্সটি, এলুমফস, এগ্রিফস, গ্যাসটক্সিন নামে পরিচিত। ইঁদুর  আছে এমন  গর্তের  মুখের মাটি  সরিয়ে  প্রতিটি সতেজ গর্তের ভিতর একটি করে বড়ি ঢুকিয়ে দিয়ে গর্তের মুখ ভালোভাবে বন্ধ করে দিতে হবে। বড়ি গর্তের ভিতর ভেজা মাটির সংস্পর্শে এলে এক প্রকার বিষাক্ত গ্যাস নির্গত হয়। এই গ্যাসে আক্রান্ত হয়ে ইঁদুর মারা যায়। গর্তের মুখসহ আশপাশের  অন্যন্য গর্তগুলো ভালোভাবে বন্ধ করে দিতে হবে যাতে গ্যাস বের হতে না পারে। বিষাক্ত গ্যাসের প্রভাবে ইঁদুর  গর্তের  ভিতর মারা যায়।

 

সতর্কতা
জিংক ফসফাইড বিষটোপ তৈরির সময় কাপড় দিয়ে নাক ঢেকে দিতে হবে। বিষটোপ তৈরির পরও ব্যবহারের পর সাবান দিয়ে ভালভাবে হাত ধুতে হবে। ছোট শিশু ও বাড়ির গৃহপালিত পশু পাখি যেন এই বিষটোপের সংস্পর্শে না আসে তা লক্ষ রাখতে হবে। মৃত  ইঁদুরগুলি একত্রিত  করে গর্তে পুঁতে  ফেলতে হবে।  বিষটোপ প্রস্তুত ও প্রয়োগে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে এবং কোন রকম অসুস্থতা অনুভব করলে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। গ্যাস বড়ি ব্যবহারে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।


কোন  নির্দিষ্ট  একক  পদ্ধতি  ইঁদুর  দমনের  জন্য  যথেষ্ট নয়। ইঁদুর  দমনের  সফলতা  নির্ভর  করে  সকলের  সম্মিলিত  প্রচেষ্টা এবং বিভিন্ন সময়োপযোগী পদ্ধতি ব্যবহারের  ওপর। অতএব সম্মিলিত এবং সময়োপযোগী দমন পদ্ধতি প্রয়োগ করলেই জমিতে ইঁদুরের উপদ্রব কমানো সম্ভব।