ইঁদুরের প্রাদুর্ভাব ও দমন ব্যবস্থাপনা

ইঁদুরের প্রাদুর্ভাব ও দমন ব্যবস্থাপনা

ইঁদুরের প্রাদুর্ভাব ও দমন ব্যবস্থাপনা


পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই কমবেশি ইঁদুরের সমস্যা  আছে। সমতল ভূমি, উঁচুভূমি, পাহাড়, পর্বত, জলাভূমি, গ্রাম, শহরবন্দর এবং উঁচু দালানকোঠা, ৩০০ মিটার নিচু খনি ও উড়োজাহাজসহ সর্বত্র এদের উপস্থিতি বিদ্যমান। ইঁদুরজাতীয় প্রাণীর উপকারী ও অপকারী ভূমিকা রয়েছে। অসংখ্য বন্যপ্রাণী ও বহু মানুষের প্রোটিনের জোগান দিয়ে থাকে। কোনো কোনো সমাজে ইঁদুরের মাংস বিশেষ ধরনের সংস্কৃতির ধারক হিসেবে বিবেচিত হয়। উদাহরণস্বরূপ দক্ষিণ ভিয়েতনামে কিছু বিবাহ অনুষ্ঠানে এক প্লেট ইঁদুরের মাংস প্রতি টেবিলে সরবরাহ ছাড়া  বিবাহোৎসব অভ্যর্থনা সম্পূর্ণ হয় না। নবদম্পতির জন্য  ইঁদুরের মাংস গুরুত্বপূর্ণ উর্বরতার প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ইঁদুরের মাংস রোস্ট হিসেবে পরিবেশন করে থাকে। Khiem et al (2003) দক্ষিণ-ভিয়েতনামের কয়েকটি প্রদেশের ইঁদুরের মাংস বাজারজাতকরণ ও হোটেলগুলোতে প্রাপ্যতা বিষয়ে জরিপ করেছিলেন। জরিপ ফলাফলে দেখা যায় যে, দক্ষিণ ভিয়েতনামের ৬টি প্রদেশে ৫টি পথে ইঁদুরের মাংস বাজারজাত হয়ে থাকে। সব মেকংগের (Mekong) সব হোটেলে ইঁদুরের মাংস প্রধান জনপ্রিয় মেনু হিসাবে বিক্রি হয়। গণনা করে দেখেছেন যে, প্রতি বছর ইঁদুরের মাংসের জন্য ৩৩০০-৩৬০০ টন জীবন্ত ইঁদুর বাজারজাত করা হয়। তাদের মতে, প্রতি বছর ২৫ লাখের বেশি সংখ্যক ইঁদুর  মাংসের জন্য বাজারজাত হয়ে থাকে। বাংলাদেশে বান্দরবান, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, দিনাজপুরসহ অনেক জেলায় বহু মানুষ ইঁদুরের মাংস খেয়ে থাকেন। দেশে কত মানুষ ইঁদুরের মাংস খেয়ে থাকে এর কোনো তথ্য নেই।  যেসব এলাকায় ইঁদুরের  মাংস খেয়ে থাকে সেসব এলাকায় অন্যান্য পণ্যের মতো কোনো মার্কেট  বা বাজার ব্যবস্থা গড়ে উঠেনি। জীবন্ত মাঠের বড় কালো ইঁদুর ও মাঠের কালো ইঁদুর যদি সমতল ভূমি এলাকা থেকে ওইসব উঁচু ভূমির ভুক্তাদের নিকট বাণিজ্যিকভাবে নেয়া হলে বাজার গড়ে উঠার সম্ভাবনা আছে। এছাড়া এশিয়া ও আফ্রিকার অনেক দেশে ইঁদুরের মাংস মানুষের প্রোটিনের উৎস। এসব দেশে অন্যান্য প্রাণীর মাংসের ন্যায় ইঁদুরের মাংস রফতানি করার জন্য মার্কেট অনুসন্ধান করার যেতে পারে। চিকিৎসা বিজ্ঞান, কৃষি বিজ্ঞান, জীববিজ্ঞানের নানা রকম পরীক্ষার জন্য ইঁদুর ব্যবহার হয়। বিভিন্ন  প্রকার বন্যপ্রাণীর  যেমন- বনবিড়াল, শিয়াল, সাপ, গুঁইসাপ, কুকুর, পেঁচা ইত্যাদি প্রাণী প্রধান খাদ্য হচ্ছে ইঁদুর। ইঁদুর যখন বনে থাকে তখন কিন্তু ইঁদুর ক্ষতিকারক বালাই নেই। ইঁদুরের প্রজনন ক্ষমতা অত্যন্ত বেশি হওয়ায় এদের নিধন করা হলেও প্রকৃতিতে কোনো প্রভাব বা ভারসাম্যহীনতা হবে না বরং নিধন না করা হলে ফসল ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা বেড়ে যাবে।


স্তন্যপায়ী প্রাণীর মধ্যে ইঁদুর জাতীয় প্রাণী দ্বারা মানুষের সম্পদ ও ফসলের, সেচের পানি, নালা, যন্ত্রপাতি, দালানকোঠা, ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট  ইত্যাদির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বেশি ক্ষতি হয়ে থাকে। এরা খাওয়ার জন্য সবকিছু ক্ষতি করে না। এদের  ছেদন দাঁত ঠিক রাখার জন্য যেখানে যে অবস্থায় থাকে সেই অবস্থাই কাটাকাটি করে। কারণ ইঁদুরের ছেদন দাঁত জন্মের পর হতে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত প্রতিনিয়ত বাড়ে ও পড়ে না। এ জন্য আজও গ্রাম অঞ্চলে শিশুদের দুধ দাঁত পড়লে ইঁদুরের গর্তে দিয়ে বলে ইঁদুরের দাঁতের মতো যেন দাঁত হয়। তবে ইঁদুরের স্বভাব যেন না পায়। ছেদন দাঁতের বৃদ্ধি রোধের জন্য কাটাকাটি করে থাকে। ইঁদুর জাতীয় প্রাণী মানুষ ও প্রাণীর ৬০ প্রকারের বেশি রোগের বাহক ও বিস্তারকারী। ইফতেখার মাহমুদ (প্রথম আলো, ১৬ জুন ২০১৫) এর জরিপ তথ্য থেকে জানা যায় যে, সাভারের নামা পাইকারি বাজারে ইঁদুরের আক্রমণে বছরে ১৬ কোটি টাকার পণ্য নষ্ট করে। বাংলাদেশের অন্যান্য মার্কেটে ইঁদুরের  দ্বারা পণ্যের ক্ষয়ক্ষতির একই চিত্র পাওয়া যাবে। এ বিষয়ে  ক্ষয়ক্ষতির কোনো জরিপ তথ্য নেই। বিভিন্ন খাদ্য মার্কেটে ইঁদুরের ক্ষয়ক্ষতির জরিপ হওয়া প্রয়োজন।   


বাংলাদেশে ইঁদুরের প্রাদুর্ভাব
গ্রামের চেয়ে শহরে ইঁদুরের প্রাদুর্ভাব বা উপদ্রব দিন দিন বেড়ে চলছে। শহরে ইঁদুরের উপদ্রব বেশি হওয়ার প্রধান প্রধান কারণগুলো হচ্ছেÑ ক. ইঁদুরভোজী প্রাণী অস্বাভাবিকহারে কমে যাওয়ার জন্য ইঁদুর বংশবিস্তার করতে পারছে। গাছপালা না থাকার কারণে বন বিড়াল, গুঁইসাপ, সাপ, শিয়াল, পেঁচা ও অন্যান্য পাখির সংখ্যা কমে গেছে। বহুতল দালানে বিড়াল পালন করে না। খ. সারা বছর শহরের খাদ্য, পানি ও বাসস্থান বিদ্যমান। কারণ ডাস্টবিন ইঁদুরকে  প্রচুর পরিমাণে খাদ্য দিয়ে থাকে। পানি সরবরাহ লাইনের পাইপ ছিদ্র বা লিকেজের কারণে পানি পেতে তাদের অসুবিধা হয় না। ড্রেনে, ডাস্টবিনের নিকট গর্ত খুঁড়ে, দালানকোঠার ভেতরে ও বাহিরের নিরাপদে বাস করতে পারে। গ. সিটি করপোরেশন এবং পৌরসভাগুলোতে মশা নিধনের কার্যক্রম রয়েছে, কিন্তু ইঁদুর নিধনের কোনো কর্মসূচি নেই। ইঁদুর নিধন করা হয় ব্যক্তিগতভাবে। সিটি করপোরেশন এবং পৌরসভাগুলোতে ইঁদুর নিধন কর্মসূচি নেয়া প্রয়োজন। এতে ইঁদুরবাহিত রোগের বিস্তাররোধ হবে এবং পানি, খাদ্যদ্রব্যের এবং রাস্তাঘাটের ক্ষয়ক্ষতি কম হবে। পরিবেশের দূষণ কমবে।


ফসলের মাঠে ইঁদুরের প্রাদুর্ভাব
বাংলাদেশে কমবেশি সব ফসলেই ইঁদুরের প্রাদুর্ভাব হয়। সবচেয়ে বেশি প্রাদুর্ভাব  ও ক্ষতি বেশি হয় গম, আমন ধান এবং ঝুম ফসলে। যে বছর বাঁশে ফুল ও ফল ধরে সে বছর ইঁদুর বন্যা হয় এবং ৮০-৯০% ঝুম ফসলের ক্ষতি হয়। গম ফসলে (২০%) ও আমন ফসলে (১০-১৫%) প্রতি বছর ইঁদুরের প্রাদুর্ভাবে ক্ষতি হয়ে থাকে। যে কোনো ফসলের থোড় হতে পাকা স্তরে ইঁদুরের আক্রমণ বেশি হয়। সারা দেশে মাঠ ফসলে ও শহরে মাঠের কালো ইঁদুরের উপস্থিতি রয়েছে।  কিন্তু দক্ষিণ অঞ্চলের জেলাগুলোতে এবং দেশের হাওড় এলাকাতে মাঠের বড় কালো ইঁদুরের উপস্থিতি বেশি রয়েছে। উভয় জাতের ইঁদুর সাতারে বেশ পটু এবং গর্তে বাস করতে পারে।

 

অন্যান্য স্থানে ইঁদুরের প্রাদুর্ভাব
 সলই ইঁদুর ও গেছু ইঁদুর ঘরবাড়ি ও দালানকোঠায় বেশি থাকে, কারণ এ প্রজাতির ইঁদুর সাধারণত গর্তে বাস করে না। হাঁস-মুরগির খামারে সাধারণত মাঠের কালো ইঁদুরের ব্যাপক উপস্থিতি রয়েছে। কারণ এরা হাঁস-মুরগির উচ্ছিষ্ট ছড়ানো ছিটানো  প্রচুর খাবার পায়, সুযোগ পেলে ডিম ও ছোট বাচ্চা খেয়ে থাকে। বর্ষার পানির জন্য মাঠের ইঁদুর বেড়িবাঁধ, সড়ক মহাসড়ক, রেলরোড, রাস্তাঘাটে মাঠের কালো ইঁদুর ও মাঠের বড় কালো ইঁদুরের প্রাদুর্ভাব ও ক্ষতি বেশি হয়ে থাকে। প্রতি কিলোমিটারে ১৫০-৩০০টির বেশি ইঁদুরের উপস্থিতি ঘটে। গর্ত খোঁড়ার জন্য সহজেই বেড়িবাঁধ, সড়ক-মহাসড়ক, রাস্তাঘাট, রেলপথ সহজেই ভেঙে যায়। এসব স্থাপনাগুলোর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে সরকারি বিভাগে ইঁদুর দমনের ব্যবস্থার কোনো সুযোগ বা ব্যবস্থা নেই। ক্ষতিগ্রস্ত স্থানগুলো মাটি দিয়ে ভরাট করা হয়। বর্ষার আরম্ভে এসব স্থাপনার ইঁদুর নিধন করা হলে ক্ষতিরোধ হবে এবং বর্ষা শেষে ইঁদুরগুলো আমন ধান ও অন্যান্য ফসলের ক্ষয়ক্ষতি অনেক কমে যাবে। গুদামজাত  শস্যে বর্ষার সময় ইঁদুরের উপদ্রব বেশি হয়। কারণ মাঠের ইঁদুরের আগমন ঘরবাড়িতে হয়। গুদাম জাত শস্যের ক্ষয়ক্ষতি ১৫-২০% বেশি হতে পারে। মলমূত্র ও লোম ফেলে খাদ্যশস্যেও ক্ষতি করে থাকে। এক্ষত্রে গেছু ইঁদুর, সলই ইঁদুর এবং মাঠের কালো ইঁদুর দ্বারা গুদামজাত শস্যের ক্ষতি হয়।


ইঁদুর দমন ব্যবস্থাপনা    
বাংলাদেশে ইঁদুর দমন ব্যবস্থাপনা ব্যক্তি নির্ভর। ইঁদুরকে সবাই চিনে। যে কোনো মানুষকে জিজ্ঞাসা করলে বলবে আপনার কি ইঁদুরের সমস্যা আছে? তখন অকাতরে বলবেন আমার ঘরের সব জিনিসপত্র কেটে শেষ করে দিয়েছে। ইঁদুরের যন্ত্রণায় ঘুমাতে পারি না। মাঠের ফসল কেটে সাবাড় করে ফেলেছে। কিন্তু ইঁদুর দ্বারা সম্পদ ও ফসলের ক্ষতি না হওয়া পর্যন্ত কেউ ইঁদুর দমন ব্যবস্থা গ্রহণ করেন না। বাংলাদেশের কৃষকরা ফসলের পোকা দমনের জন্য ৫০০-৩০০০ টাকার বেশি খরচ করে থাকেন। কিন্তু ফসলের মাঠে ইঁদুর দমনের জন্য ১০ টাকাও খরচ করতে চায় না। সাধারণত ঘরবাড়ি ও বাসাবাড়ির ইঁদুর ব্যক্তিগত উদ্যোগে নিধন করে থাকে। কৃষি বৈজ্ঞানিকরা ইঁদুরের চেয়ে পোকামাকড় ও রোগবালাই নিয়ে গবেষণা ও কাজ করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য ও সম্মানজনক মনে করে থাকেন। ইঁদুর দমন প্রযুক্তির উন্নয়নের গবেষণা ও সম্প্রসারণের জন্য সরকারিভাবে তেমন অর্থের ব্যবস্থা নেই। ভারতে প্লেগ রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে তখন কয়েক দিন ইঁদুরের গুরুত্ব পেয়ে থাকে। যদিও ইঁদুর দ্বারা পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে যে কোনো বালাইয়ের চেয়ে ফসল, সম্পদ ও রোগবালাইয়ের ক্ষয়ক্ষতি অনেকগুণ বেশি। ইঁদুরের ক্ষয়ক্ষতি ব্যাপারের অন্যান্য বালাইয়ের চেয়ে গুরুত্ব  সরকারিভাবে ও ব্যক্তি পর্যায়ে অনেক কম দেয়া হয়। যদিও সবাই জানে ইঁদুর একটি অত্যন্ত ক্ষতিকর প্রাণী। ইঁদুর দমন ব্যবস্থা ও প্রযুক্তি অন্যান্য বালাই হতে সম্পূর্ণ আলাদা। কারণ একটি পদ্ধতি দ্বারা ইঁদুর দমন করা বাস্তবে সম্ভব নয়। ইঁদুর দমন পদ্ধতি সঠিক স্থানে, সঠিক সময়ে ও সঠিকভাবে প্রয়োগ করতে হবে। একজন কৃষক বলেছিলেন ইঁদুর মারতে হলে ইঁদুরের চেয়ে স্মার্ট হতে হবে।


কৃষক পর্যায়ে ইঁদুর দমন ব্যবস্থাপনা
বাংলাদেশের কৃষকরা বিভিন্ন রকমের (১০-১৫ প্রকারের অধিক) ফাঁদ ব্যবহার করে থাকে। অনেক ফাঁদ কৃষকদের নিজেদের উদ্ভাবনকৃত, যেমন- বাঁশের তৈরি ফাঁদ। এ ফাঁদগুলো গর্তে অবস্থানকারী ইঁদুরের জন্য খুবই কার্যকর। এ ফাঁদগুলো বাজারে পাওয়া যায় না। কৃষকরা নিজেরাই তৈরি করে থাকে। কাঠের তৈরি ফাঁদ বাজারের পাওয়া যায়।

লোহার তৈরি নানা রকম জীবন্ত ও মৃত ইঁদুর ধরার ফাঁদ বাজারে পাওয়া যায়। ব্যক্তি পর্যায়ে একটি বা দুইটি ফাঁদ ব্যবহার করে থাকে। এতে কয়েকটি ইঁদুর মারা সম্ভব হয়। কম পক্ষে ৫টি ফাঁদ ব্যবহার করা হলে এর কার্যকারিতা বেশি পাওয়া যাবে।   

           
ইঁদুর দমনের জন্য গ্লুবোর্ড হার্ডওয়ারের দোকানে পাওয়া যায়। একটি গ্লুবোর্ড দ্বারা ৫-১০টি ছোট বড় ইঁদুর নিধন করা যায়। বাসাবাড়িতে  এবং অফিসে গ্লুবোর্ডের ফাঁদ ব্যবহার করা হলে ইঁদুর মরে গন্ধ হওয়ার সম্ভাবনা নেই।


ঝুম ফসল রক্ষা করার জন্য কৃষকরা বাঁশের বেড়া দিয়ে মাঝে মাঝে বাঁশের ফাঁদ ব্যবহার করে থাকেন। এ পদ্ধতি বেশ কার্যকর। ফসলের মাঠের চারদিকে পলিথিন দিয়ে ঘেরা দিয়ে মাঝে মাঝে বাহিরে ও ভেতরে জীবন্ত ইঁদুর ধরার ফাঁদ পেতে রাখতে হবে। ইন্দোনেশিয়ায় এ পদ্ধতিতে ইঁদুর দমন করা হয়।


দক্ষিণ অঞ্চলে জোয়ারের সময় টেঁটা দিয়ে মাঠের বড় কালো ইঁদুর সহজেই নিধন করা যায়। জোয়ারের সময় ধান ফসল ডোবে গেলে ইঁদুর কচুরিপানার দলে, হুগলা গাছে এবং মাঠের গাছে আশ্রয় নিয়ে থাকে। এ সময় দল বেঁধে ইঁদুর নিধন করা হলে আমন ফসলের ইঁদুর দ্বারা ক্ষয়ক্ষতি অনেক কম হবে।

 

ইঁদুরনাশক দ্বারা ইঁদুর দমন
সবাই মরা ইঁদুর দেখতে চায়। অধিকাংশ মানুষ ইঁদুর নিধনে জিংক ফসফাইড ব্যবহার করে থাকে। যুগযুগ ধরে জিংকফসফাইড এ দেশে প্রয়োগ হচ্ছে। বাজার থেকে নিয়ে এ বিষ ব্যবহার করে থাকে। এ বিষ ব্যবহারকারীদের জিজ্ঞাসা করলে বলবে বিষে কাজ হয় না, ইঁদুর মরে না, খায় না ইত্যাদি। কৃষকরা ইঁদুরকে খাওয়ানোর জন্য টোপ হিসেবে নানা রকম খাদ্য ব্যবহার করে থাকেন। এ বিষের প্রধান সমস্যা হচ্ছে- সঠিক মাত্রার তৈরি না হলে ইঁদুর বিষটোপ খাবে না বা খেলেও মারা যাবে না। জিংক ফসফাইডের সঠিকমাত্রা হচ্ছে ২%। গমের সাথে মিশ্রিত ২% বিষটোপ বাজারে পাওয়া যায়। ফ্রেস চিংড়ি মাছ অথবা শামুকে ২% জিংক ফসফাইড বিষ মিশিয়ে ইঁদুরের গর্তে একটি চিংড়ি বা শামুক প্রয়োগ  করে ইঁদুর নিধন করা যায়। মুন্সীগঞ্জে গোল আলো খেতে তাজা কাকড়ার গায়ে জিংক ফসফাইড লাগিয়ে ইঁদুরের গর্তে ছেড়ে দিয়ে কৃষকরা সফলভাবে ইঁদুর দমন করতে পেরেছেন বলে জানিয়েছেন। বাজারে বহুমাত্রার তৈরি বিষটোপ  যেমন-ল্যানির‌্যাট, ব্রমাপয়েন্ট পাওয়া যায়। এ বিষটোপ ইঁদুরকে ৩/৪ বার খাওয়াতে হবে এবং খেলে ৭-১০ দিন  পর মারা যাবে। এ বিষটোপে না খাওয়ার সমস্যা নেই। ১০০% ইঁদুরের পপুলেশন নষ্ট করা সম্ভব হবে। বিষটোপ ব্যবহারে সাবধানতার নিয়মগুলো অবশ্যই অনুসরণ করতে হবে।

 

গ্যাস বড়ি দিয়ে ইঁদুর নিধন
গ্যাসবড়ি (অ্যালুমেনিয়াম ফসফাইড ৩ গ্রাম) সাধারণত গুদামজাত খাদ্য শস্যের পোকা দমনের জন্য ব্যবহার হয়। বর্তমানে ইঁদুর নিধনে গ্যাস বড়ির ব্যবহার কৃষকদের নিকট বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। গর্তে বসবাসকারী ইঁদুর নিধনের জন্য খুবই কার্যকর। একটি গর্তে ৩ গ্রামের একটি বড়ি প্রয়োগ করে সব গর্তের মুখ মাটি দিয়ে বন্ধ করে দিতে হবে। যে কোনো ফসল থোর থেকে পাকা স্তরে  ফসলে প্রয়োগকৃত বিষটোপ ইঁদুর খায় না। এ ক্ষেত্রে গ্যাস বড়ি প্রয়োগ করা উত্তম। গ্যাসবড়ি প্রয়োগে সাবধানতার নিয়ম মেনে প্রয়োগ করতে হবে।

 

ইঁদুর নিধন অভিযান
প্রতি বছর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর দেশে ইঁদুর নিধন অভিযান কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে থাকে। অভিযানে জাতীয়, আঞ্চলিক, জেলা পর্যায়ে জনগণকে ইঁদুর নিধনে উৎসাহ প্রদানের জন্য বেশ কিছু পুরস্কার প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে। এক গবেষণা তথ্য থেকে জানা গেছে যে, ৮৬% কৃষক পুরস্কারের পরিবর্তে বাজারে ভলোমান সম্পন্ন  ইঁদুরনাশক বিষটোপ সরবরাহ চেয়েছেন। তাদের যুক্তি হলো পুরস্কার দ্বারা অল্প সংখ্যক ব্যক্তি উপকৃত হয়ে থাকে। আকর্ষণীয় পুরস্কারের পরিবর্তে বিষটোপ এবং ফাঁদ সরবরাহ করা হলে অভিযানের দীর্ঘমেয়াদি ফলাফল ভালো হবে। এ ক্ষেত্রে অভিযানের সময় প্রতি গ্রাম হতে ২ জন কৃষকে একদিনের প্রশিক্ষণ দিয়ে বিষটোপ ও ফাঁদ দেয়া যেতে পারে। এতে সারা দেশে ৬৮,০০০০ কৃষক ইঁদুর দমনের প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণ পাবে। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কৃষকরা গ্রামবাসীদের ইঁদুর নিধনে প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদান করবেন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের ইঁদুর দমনের প্রযুক্তিগত জ্ঞান বৃদ্ধির জন্য একটি প্রশিক্ষণ ম্যানুয়েল  তৈরি করে সরবরাহ করা প্রয়োজন।


দলগতভাবে ইঁদুর নিধন ব্যবস্থাপনা
নিজের ইঁদুর নিজেকেই মারতে হবে ইহা যেমন সত্য, তেমনি একা ইঁদুর নিধন করে ভালো ফল হবে না ইহা বাস্তব সত্য। ইঁদুরের সমস্যা একটি সামাজিক সমস্যা। কমিউনিটির সব স্তরের মানুষের অংশগ্রহণ ছাড়া ইঁদুর দমন কার্যকর হবে না। সিঙ্গাপুরের দেশকে প্লেগমুক্ত রাখার জন্য আইন করা হয়েছে কোনো বাড়ির আঙিনায় ইঁদুরের উপস্থিতি পাওয়া গেলে মোটা অংকের জরিমানা দিতে হবে। এতে ওই দেশে ইঁদুর দমনের ক্ষেত্রে শহরে সফলতা পেয়েছে। ফিলিপাইনে কমিউনিটি পদ্ধতিতে ইঁদুর দমন করে সফল হয়েছে। এক্ষেত্রে তারা একটি গ্রাম বা পাড়া নির্বাচন করে ৫-১০ সদস্যের কমিটি করে সারা বছর ইঁদুর দমন কার্যক্রম পরিচালনা করেছে । কমিটির সদস্যদের ইঁদুর দমন প্রযুক্তি বিষয়ে প্রশিক্ষণ ও উপকরণ দিয়ে সহায়তা করতে হবে। দলগতভাবে ইঁদুর দমন করে বিএডিসি দশমিনা বীজ বর্ধন  ১০০০ একর খামারে সফলতা পেয়েছে। এ খামারে ৭০-৮০% ধান ফসল ইঁদুর দ্বারা প্রতি বছর ক্ষতি হতো। বর্তমানে দলগতভাবে ইঁদুর দমন ব্যবস্থাপনার ফলে খামারের ফসলের ৫% ভাগের নিচে রাখা সম্ভব হয়েছে। ইঁদুর দমন কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলা প্রয়োজন। দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলার জন্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ইঁদুর দমন ব্যবস্থা উন্নয়নের প্রল্প গ্রহণ করা প্রয়োজন। দেশে সারা বছর ধরে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধির সাথে সাথে ইঁদুরের  পপুলেশন সমস্যা ও ক্ষয়ক্ষতি বৃদ্ধি পাচ্ছে। সঠিক প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও প্রয়োগ ছাড়া এ সমস্যা সমাধান করা বাস্তবে সম্ভব হবে না।