ত্তম কৃষি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তার জন্য পরিবেশ বান্ধব বিষমুক্ত নিরাপদ ফসল উৎপাদন

ত্তম কৃষি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তার জন্য পরিবেশ বান্ধব বিষমুক্ত নিরাপদ ফসল উৎপাদন

উত্তম কৃষি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তার জন্য পরিবেশ বান্ধব বিষমুক্ত নিরাপদ ফসল উৎপাদন


উত্তম কৃষি ব্যবস্থাপনাঃ

ভোক্তার কাছে নিরাপদ খাদ্য পৌঁছানোর লক্ষ্যে কৃষি ক্ষেত্রে ব্যবহৃত পদ্ধতি ও প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহারই হচ্ছে উত্তম কৃষি ব্যবস্থাপনা। উত্তম কৃষি ব্যবস্থাপনার উদ্দেশ্য হচ্ছে ভোক্তার কাছে নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত কৃষিপণ্য সরবরাহ করা। উত্তম কৃষি ব্যবস্থাপনার মধ্যে কৃষি পণ্য উৎপাদনে ব্যবহৃত সকল পদ্ধতি ও প্রযুক্তি অর্ন্তভূক্ত। নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত কৃষিপণ্য উৎপাদনে যে সকল উপাদান গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করতে হবে সেগুলো হলোঃ

- উন্নত জাত ও ভালমানের বীজের ব্যবহার

- পানি ব্যবস্থাপনা

- জৈব সার ও সুষম সারের ব্যবহার

- সঠিক উপায়ে সঠিক মাত্রায় বালাইনাশকের ব্যবহার

- উদ্ভিদ হরমোনের সঠিক ব্যবহার

- সময়মত ফসল সংগ্রহ

- ফসল বাছাই ও বাজারজাতকরণ

- আন্তঃপরিচর্যা

উপরোক্ত বিষয়গুলোর সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমেই কেবল নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন করা সম্ভব।


খাদ্য নিরাপত্তাঃ

পর্যাপ্ত পরিমাণ কৃষিপণ্য উৎপাদন, বিশেষ করে খাদ্য উৎপাদনের মাধ্যমে ক্ষুধা ও দারিদ্রমুক্ত জাতি গঠন করাই হচ্ছে খাদ্য নিরাপত্তা। আরো বড় পরিসরে বলতে গেলে খাদ্য নিরাপত্তা হচ্ছে সকলের জন্য বিষমুক্ত, নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করা।


নিরাপদ ফসলঃ

নিরাপদ ফসল বলতে বুঝায় যা আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত। নিরাপদ ফসল সেগুলোই যা কীটনাশক, রোগবালাই ও স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর সকল কিছু থেকে মুক্ত। আর এই নিরাপদ ফসল নিশ্চিত করতে হলে আমাদের উত্তম ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ফসল উৎপাদনের কোন বিকল্প নেই।


জৈব সারঃ

গাছ বেঁচে থাকার জন্য মাটি থেকে খাবার গ্রহণ করে আর জৈব সার হচ্ছে সেই মাটির প্রাণ। জীব দেহ হতে প্রাপ্ত বা জীবদেহের ধ্বংশাবশেষ হতে প্রাপ্ত বা প্রস্তুত সারই জৈব সার। গোবর সার, খামারজাত সার, কম্পোস্ট, আবর্জনা সার, খৈল, সবুজ সার, ছাই, হাড়ের গুড়া, মাছের গুড়া প্রভৃতি জৈব সার।


জৈব সারের উপকারিতাঃ

- একাধিক উদ্ভিদ পুষ্টি উপাদানের উত্তম উৎস। ফসফরাস, পটাসিয়াম, ও অন্যান্য খাদ্য উপাদানের অভাব পূরণ হয়।

- পুষ্টি উপাদান জমিতে অনেক দিন থাকে।

- রাসায়নিক সারের কার্যকারিতা বাড়ায় ও গাছ কর্তৃক রাসায়নিক সারের গ্রহনক্ষমতা বৃদ্ধি করে।

- মাটিতে উপকারি জীবাণুর সংখ্যা বৃদ্ধিকরে।

- মাটির গঠন ও সংযুক্তি উন্নত করে।

- মাটির বিষাক্ততা দূও করে।

- পানি ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি করে ফলে সেচের পানির অপচয় কমে।

- বায়ু চলাচল ক্ষমতা বৃদ্ধি করে মাটি নরম, আলগা ও ঝুরঝুরে করে।

সার ব্যবস্থাপনাঃ

মাটির স্বাস্থ্য ঠিক রেখে একই জমি থেকে একাধিকবার অধিক ফসল উৎপাদনের লক্ষ্যে নিয়মিত মাটি পরীক্ষা করে সময়মত ও পরিমাণমত সার ব্যবহার করা উচিত। জমিতে সুষম সারের ব্যবহারে ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির সাথে সাথে মাটির গুনাগুণ রক্ষাা করে। মাটি পরীক্ষা সুষম সার ব্যবস্থাপনার পূর্বশর্ত।

সার ব্যবহার নীতিমালাঃ

- এক বস্তা (৫০ কেজি) ডিএপি সার ব্যবহার করলে একই পরিমাণ টিএসপি (৫০ কেজি) এবং তার সঙ্গে বাড়তি ২০ কেজি ইউরিয়া সারের সুফল পাওয়া যায়।

- ধান ফসলে থোর আসা কালে বিঘা প্রতি ৭-৮ কেজি হারে পটাশ সার ব্যবহারে বিভিন্ন রোগের উপদ্রব কমিয়ে ফলন বাড়ানোর ব্যবস্থা নেয়া যায়।

- গুড়া ইউরিয়া সারের বদলে শতকরা ৩০ ভাগ গুটি ইউরিয়া সার কম ব্যবহার কওে, শতকরা ২০ ভাগ বেশি ফসল ঘরে তোলা যায়।

- জিং আর ফসফেট সার একত্রে মিশালে বিষাক্ততা সৃষ্টি হয় ও গাছের কোন কাজে আসে না।

- ফসফেট সার জমি তৈরির সময় শেষ চাষের ২/১ দিন পূর্বে প্রয়োগ করা উচিত এবং দস্তা সারও শেষ চাষের সময় প্রয়োগ করতে হবে।

- জৈব সার ফসল বপন/রোপনের কমপক্ষে  ৭-১০ দিন পূর্বে জমিতে প্রয়োগ করে মাটির সঙ্গে মিশিযে দিতে হবে। 

সার  ব্যবহারের সময়ঃ

- ধান ফসলের ক্ষেত্রে ইউরিয়া সার তিন কিস্তিতে ব্যবহার করতে হবে। প্রথম কিসিÍ চারা লাগানোর ২ সপ্তাহ বা ১৪ দিন পর, ২য় কিস্তি চারা লাগানোর ৩৫-৪০ দিন পর, তৃতীয় কিস্তি গাছে থোর আসার সময় প্রয়োগ করতে হবে। এমওপি সার চারা রোপনের ৫০-৫৫ দিন পর পুনরায়  মোট পরিমাণের অর্ধেক হারে ব্যবহার করা উচিত।

- ফল গাছের ক্ষেত্রে বর্ষার শুরু ও শেষে গাছের বয়স অনুপাতে পরিমাণ মত সার গাছের চারিদিকে রিং করে প্রয়োগ করতে হবে।


কৃষির সকল ক্ষেত্রেই আমরা উত্তম কৃষি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত ফসল উৎপাদন করতে পারি। এখানে উদাহরণ স¦রূপ আমের সকল ব্যবস্থাপনা আলোচনা করা হলোঃ


জমি নির্বাচনঃ

উঁচু ও মাঝারি উঁচু জমি নির্বাচন করা প্রয়োজন।গভীর, সুনিষ্কাশিত ও উর্বর দোঁআশ মাটি উত্তম।

চারা/কলম নির্বাচন ও রোপণের সময়ঃ

এক বছর বয়স্ক সুস্থ, সবলও রোগমুক্ত কলমের চারা নির্বাচন করা প্রয়োজন।

মে-মধ্য জুলাই (মধ্য বৈশাখ-শেষার্ধ আষার) মাস চারা/কলম রোপণের উপযুক্ত সময়। তবে সেচের সুবিধা থাকলে বর্ষাকাল এবং বর্ষার শুরুতেও (মার্চ- এপ্রিল) চারা লাগানো যায়।


রোপণ পদ্ধতিঃ

গাছ থেকে গাছের দূরত্ব ১২ মি * ১২ মি হওয়া উচিত। তবে গাছের বৃদ্ধি কম হলে ১০ মি * ১০ মি এবং খাটো জাতের জন্য ৮ মি *৮ মি  দূরত্বে গাছ রোপন করা যায়। গাছ রোপনের ১০-১৫ দিন পূর্বে অন্তত ১মি*১মি*১মি আকারের গর্ত করতে হবে। চারা অথবা কলম লাগানোর ১০-১৫ দিন পর গর্তেও মাটির সাথে ২০ কেজি পচা জৈব সার বা গোবর, ৫০০ গ্রাম টিএসপি, ২৫০ গ্রাম এমওপি, ২৫০ গ্রাম জিপসাম, ৫০ গ্রাম জিংক সালফেট এবং ৫০ গ্রাম বরিক এসিড ভালভাবে মিশিয়ে গর্ত ভরাট করতে হবে।


চারা রোপণঃ

গর্ত ভর্তির ১০-১৫ দিন পর এক বছর বয়স্ক সুস্থ, সবল ও রোগমুক্ত চারা রোপণ করতে হবে। আমের চারা পলিথিন ব্যাগ/ টব হতে আলাদা করে গোড়ার মাটির বলসহ গর্তেও মাঝখানে সোজাভাবে লাগিয়ে চারিদিকে প্রয়োজনীয় মাটি দিয়ে গোড়ার মাটি সামান্য চেপে দিতে হবে। চারা রোপণের পর অবশ্যই পানি, খুঁটি ও বেড়ার ব্যবস্থা করতে হবে।


সারের মাত্রা ও সার প্রয়োগ পদ্ধতিঃ


সারের নাম গাছের বয়স (বছর)

গাছপ্রতি সারের পরিমাণ

                 ১-৪   ৫-৭          ৮-১০         ১১-১৫          ১৬-২০          ২০- উর্ধ্বে

গোবর (কেজি) ৩০         ৩৫          ৪৫                   ৫৫            ৭৫                    ৯০

ইউরিয়া (গ্রাম) ৪৪০        ৮৭৫       ১৩০০                ১৭৫০                ২৬২৫                 ৩৫০০

টিএসপি (গ্রাম) ৪৪০         ৪৪০        ৮৭৫                  ৮৭৫         ১৩০০          ১৭৫০

এমওপি (গ্রাম) ১৭৫        ৩৫০        ৪৪০                  ৭০০          ৮৭৫          ১৪০০

জিপসাম (গ্রাম) ১৭৫         ৩৫০        ৪৪০                   ৬০০         ৭০০                   ৮৭৫

জিংক সালফেট (গ্রাম) ১৮ ১৮         ২৬                  ২৬                  ৩৫                   ৪৪

বরিক এসিড (গ্রাম) ৩৫ ৩৫         ৫২                  ৫২                  ৭০             ৮৮


গোবর, টিএসপি, জিপসাম, জিংক সালফেট ও বরিক এসিড সবটুকু এবং অর্ধেক ইউরিয়া ও এমওপি সার ফল সংগ্রহের পর পরই সেপ্টেম্বর মাসে প্রয়োগ করতে হবে। বাকী অর্ধেক পরিমাণ ইউরিয়া ও এমওপি সার সমান দুই ভাগ করে একভাগ মার্চ মাসের মাঝামাঝি ( ফল মটর দানার আকার ধারণ করলে) এবং অপরভাগ মে মাসের মাঝামাঝি ( আম পরিপক্ব হওয়ার এক মাস পূর্বে) সময়ে প্রয়োগ করতে হবে। গাছের বয়স ১-৩ বছর হলে গোড়ার ৩ সেমি থেকে ১ মিটার দূরত্বে অথবা দুপুর বেলায় গাছের গোড়ায় যতটুকু জায়গায় ছায়া পড়ে সেই জায়গায় হালকাভাবে কুপিয়ে ৫-১০ সেমি গভীর করে মোট সারের ৪-৬ ভাগ করে ২ মাস পরপর প্রয়োগ করতে হবে। প্রতিবার সার প্রয়োগের পর হালকা সেচ দিতে হবে।


সেচ প্রয়োগঃ

আম গাছে শুষ্ক মৌসুমে (নভেম্বর- এপ্রিল) বেশি এবং বর্ষাকালে (মে-জুন) কম সেচের প্রয়োজন পড়ে। জমিতে রসের উপর ভিত্তি করে আম বাগানে সেচ প্রদান করা উচিৎ। পূর্ণবয়স্ক গাছে সাধারণত দুইটি সেচের প্রয়োজন পড়ে। প্রথম বার সম্পূর্ণ মুকুল ফোটার পর্যায়ে এবং দ্বিতীয় বার ফল মটর দানার আকৃতি ধারণ পর্যায়ে। এছাড়া মুকুল ফোটার পর হতে ফল পরিপুষ্ট হওয়া পর্যন্ত প্রতি ১৫ দিন পরপর সেচ দেওয়া অত্যন্ত জরুরি। ফুল আসার ২-৩ মাস পূর্ব থেকে সেচ দেওয়া সম্পূর্ণ বন্ধ করতে হবে। বৃষ্টির সময় অতিরিক্ত পানি জমি থেকে বের করে দিতে হবে।


আন্তঃপরিচর্যাঃ

সাধারণত আম বাগানে বছরে দুইবার চাষ দিতে হবে। প্রথম চাষ বর্ষা মৌসুম শুরু হওয়ার পূর্বে এবং আরেকটি চাষ বর্ষার পরে দিতে হবে, যা আগাছা, পোকামাকড় দমন ও মাটির রস সংরক্ষণে সহায়তা করে।

গাছের বয়স ২-৩ বছর হলে ডাল ছাঁটাই করতে হবে। গাছের প্রধান কান্ডের অন্তত ১ মিটার পর্যন্ত ডালপালা রাখা যাবে না এবং কলমের নিচ থেকে কুশি বের হলে সেগুরো নিয়মিত অপসরণ করতে হবে। প্রতি বছর ফল সংগ্রহের পর রোগাক্রান্ত, শুকনো ও দুর্বল ডালপালা কেটে/ ছেঁটে দিতে হবে। এচাড়াও সাথে সাথে পরগাছা পরিস্কার করে দিতে হবে।


আমের বালাই ব্যবস্থাপনাঃ


আমের শোষক পোকার প্রতিকারঃ আম বাগানে সবসময় প্রয়োজন অনুযায়ী গাছের ডালপালা ছাঁটাই করতে হবে। আমের মুকুল যখন ৫-৬ সেমি লম্বা হয় তখন একবার এবং আম মটর দানার মত হলে আর একবার প্রতি লিটার পানিতে ১ মিলি হারে সাইপারমেথ্রিন জাতীয় কীটনাশক মিশিয়ে সম্পূর্ণ গাছে স্প্রে করতে হবে।


মাছি পোকার প্রতিকার ঃ আক্রান্ত আম সংগ্রহ করে মাটির নিচে গর্ত করে পুঁতে ফেলতে হবে। আম পরিপক্ব ও পাকার মৌসুমে আম বাগানে ব্লিচিং পাউডার প্রতি লিটার পানিতে ৫ গ্রাম হারে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। ফেরোমন ফাঁদ ব্যবহার করলেও মাছি পোকার আক্রমণ কমে যায়। আমি ব্যাগিং করলে মাছি পোকা আক্রমণ করতে পারেনা। এব্লিচিং পাউডার প্রতি লিটার পানিতে ৫ গ্রাম হারে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। ফেরোমন ফাঁদ ব্যবহার করলেও মাছি পোকার আক্রমণ কমে যায়। আমি ব্যাগিং করলে মাছি পোকা আক্রমণ করতে পারেনা। এছাড়া প্রতি ১০০ গ্রাম পাকা আমের রসের সাথে  ০.৫ গ্রাম সেভিন মিশিয়ে বিষটোপ বানিয়ে বাগানে রেখে মাছি পোকা দমন করা যায়।


এ্যানথ্রাকনোজ রোগের প্রতিকারঃ প্রতি বছর রোগাক্রান্ত বা মরা ডালপালা ছাঁটাই করে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। আম সংগ্রহের ১৫ দিন আগ পর্যন্ত মেনকোজেব গ্রুপের ছত্রাকনাশক প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে বা কার্বেন্ডাজিম জাতীয় ছত্রাকনাশক প্রতি লিটার পানিতে ১ গ্রাম হারে মিশিয়ে আমের মুকুল ৫-৬ সেমি হলে একবার এবং আম মটর দানার মত হলে আরেকবার স্প্রে করতে হবে।


ফল সংগ্রহ ও সংরক্ষণঃ জাতভেদে ফল ধারণ এর ৯০-১৩০ দিন ফল পরিপক্ব হয়। ফল হাত দিয়ে সংগ্রহ করা ্ভাল। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বাঁশে ঠুসি ব্যবহৃত হয়। আমগুলো ছোট বড় আকার দেখে আলাদা করে বাঁশের ঝুড়িতে সংরক্ষণ করা হয়। তবে আম পরিবহনের ক্ষেত্রে প্লাস্টিকের ক্রেট ব্যবহার করলে আম ভাল থাকে।